ই-লার্নিং: কেন, কিভাবে

লেখাটি শেয়ার করুন

লেখাটিতে যা থাকছে

প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে পৃথিবী। যাপিত জীবনের নানা অভ্যাস, কাজকর্মে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের অভ্যস্ত যাপনকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ব্যপক পরিবর্তন এনেছে এই প্রযুক্তি। জ্ঞান বইয়ের পাতা থেকে এখন গুগল, ইউটিউবে। পকেটে রাখা স্মার্টফোনে পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম! হ্যা, শিক্ষাকে প্রযুক্তির সাথে ব্লেন্ড করে তা অনলাইনে সরবরাহের যে ধারনা একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে, সেটাকেই আমরা ই-লার্নিং বা ইন্টারনেট লার্নিং বলছি। পকেটেই থাকছেন পৃথিবীর বিখ্যাত সব প্রশিক্ষক !

ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি ক্লাস করা কিংবা কোনো বিষয়ের উপর জ্ঞানার্জন করার পদ্ধতিই ই-লার্নিং নামে পরিচিত। বর্তমানে অনলাইনে ছোট ছোট কোর্স করে সুনিদৃষ্ট বিষয়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির এ প্রচেষ্টা গ্লোবালি একটি জনপ্রিয় পন্থা হয়ে উঠছে। পাশাপাশি ইউরোপ আমেরিকার তাবৎ সব বড় বড় কর্পোরেশন নিজেদের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ই-লার্নিং পদ্ধতির দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে। ই-লার্নিং বিষয়টিকে বোঝাতে গিয়ে ই-লার্নিং: কনসেপ্টস, এপ্লিকেশন, ট্রেন্ডস শীর্ষক বইতে বলা হয়েছে, `E-learning is a computer based educational tool or system that enables you to learn anywhere and at any time. Today e-learning is mostly delivered though the internet, although in the past it was delivered using a blend of computer-based methods like CD-ROM.’

ই-লার্নিং মূলত শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক (Learner driven-Learner Centric Learning), অন্যদিকে প্রচলিত ক্লাসরুম ভিত্তিক শিক্ষণ পদ্ধতি পুরোটাই শিক্ষক কেন্দ্রিক (Teacher Centric Learning)। প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা ও বাছাই করার সুযোগ কম থাকে, কিন্তু ই-লার্নিং-এ শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে শিখবে বা শিখবে না, কোন জায়গা থেকে কোন পদ্ধতিতে শিখবে, সে বিষয়ে স্বাধীনতা থাকে। অনেকেই ই-লার্নিংকে নানা ভাগে ভাগ করে থাকেন। মূলত শিক্ষাটি কিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং গ্রহীতা কিভাবে, কি উপায়ে শিক্ষা উপকরণ গ্রহন করছেন, সেসবের ভিত্তিতেই এই শ্রেণীবিভাগ। মধ্যপ্রাচ্যের ই-লার্নিং গবেষক আবদুল্লাহ ফাতেহ আলঘাতনি ই-লানিংকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হলো কম্পিউটার ভিত্তিক ই-লার্নিং ও অপরটি ইন্টারনেট ভিত্তিক ই-লার্নিং।

কম্পিউটার ভিত্তিক ই-লার্নিং সাধারনত তুলনামূলক পুরাতন এপ্রোচ, যেখানে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে ক্লাসরুমের বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একজন শিক্ষার্থী কম্পিউটার চালিত নির্দেশনা কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। অপরদিকে ই-লার্নিং গবেষক আলমোসার মতে (২০০১), ইন্টারনেট ভিত্তিক লার্নিং হলো কম্পিউটার ভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়ার উন্নত সংস্করণ, যেখানে ই-লার্নিং প্রোগ্রামের কনটেন্ট সর্বদা অনলাইনে পাওয়া যায়, এবং যে কোন শিক্ষার্থী যে কোন সময় সেই কনটেন্টগুলো পাঠ করে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। ই-লার্নিং তাত্ত্বিকগণ আবার সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ভিত্তিক এই ই-লার্নিং পদ্ধতিকে synchronous এবং asynchronous এই দুই ভাগে ভাগ করেন। ই-লার্নিং এর ধরন, অনলাইনে শিক্ষা সরবরাহের পদ্ধতি বিবেচনায় আবদুল্লাহ ফাতেহ আলঘাতনি ২০১১ সালে তার প্রকাশিত একটি থিসিসে একটি ই-লার্নিং মডেল উপস্থাপন করেন, যেটা নিম্নরুপ :

ই-লার্নিং নানা কারনেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানতম কারনটি হলো এটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি উভয়ের সময়, খরচ ও পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। এছাড়া এটি স্ব-শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে পারে। ই-লার্নিং পদ্ধতিতে ঘরে বসে সুবিধাজনক সময়ে পছন্দমতো বিষয়ে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ আছে। এছাড়া এখানে ধরাবাঁধা ক্লাসের ব্যাপার না থাকায় সুবিধামতো সময়ে শেখার কাজটি চালিয়ে নিতে পারেন একজন শিক্ষার্থী। ই-লার্নিং ব্যাক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠেছে, যদিও আমাদের দেশে এখন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রচলিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিই চলে আসছে।

ইতিহাসের আয়নায় ই-লার্নিং

ই-লার্নিং শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৯৯ সালে। ই-লার্নিং শব্দবন্ধের সাথে যুক্ত ‘অনলাইন লার্নিং’ কিংবা ‘ভার্চুয়াল লার্নিং’ শব্দদ্বয়ও সমসাময়িক সময়ে ব্যবহার হওয়া শুরু করে। তবে দূরশিক্ষনের যে ধারনা, তা কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তি আসার আগেই শুরু হয়েছে। ১৮৪০ সালে বৃটিশ নাগরিক স্যার আইজ্যাক পিটম্যান প্রথম তার শিক্ষার্থীদের জন্য দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। তিনি সেসময় শিক্ষার্থীদেরকে শর্টহ্যান্ড রাইটিং শেখানোর জন্য পোষ্টকার্ডে শর্টহ্যান্ড লিখে পাঠিয়ে দিতেন এবং শিক্ষার্থীরা শর্টহ্যান্ডগুলোকে বুঝে নিয়ে সেগুলোর অর্থ উদ্ধার করে ফিরতি খামে লিখে পাঠাতেন। এরপর ১৯২৪ সালে প্রথম ‘টেস্টিং মেশিন’ আবিষ্কৃত হয়, যেটা দিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারতেন। এরপর ১৯৫৪ সালে হাভার্ডের অধ্যাপক বিএফ স্কিনার ‘টিচিং মেশিন’ আবিষ্কার করেন, যেটার মাধ্যমে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন নির্দেশিকা পূর্বেই তৈরি করে রাখতেন, যা পরবর্তিতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করতেন।

১৯৬০ সালে পৃথিবীতে প্রথম কম্পিউটার ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী যাত্রা শুরু করে। স্বয়ংক্রিয় শিক্ষা সরবরাহের এ পদ্ধতিকে তখন বলা হতো প্লাটো-প্রোগ্রামড লজিক, যা প্রথমে আমেরিকার ইলিনিয়স বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হলেও পরবর্তিতে পাশ্ববর্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চালু হয়। ১৯৭০ সালের দিকে এসে প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম আরও মিথষ্ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সে সময় ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটি ইন্টারনেট ব্যবহার করে মেইলের মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষা সরবরাহের সুযোগটির সর্বাধিক ব্যবহার করে। এরপর ১৯৮৪ সালে এ্যাপেলের ম্যাকোনটিশ আসার পর বদলে সবকিছু। টেক্সনির্ভর কম্পিউটার প্রযুক্তি বদলে অনেকটাই গ্রাফিকাল ও ইমেজ নির্ভর হয়ে ওঠে। এর মাউসের ব্যবহার ও বৈশিষ্ট শিক্ষার্থীর মিথষ্ক্রিয়ার ধরনকে আরও সক্রিয় করে তোলে।

১৯৯০ সালে আসে মাল্টিমিডিয়া পিসি, যেটাতে যুক্ত হয় সিডি রম। এসময় মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্টর আসলে অনলাইনে শিক্ষা সরবরাহে আসে বৈপ্লিবিক পরিবর্তন। ভিডিও, অডিও, গ্রাফিকস ও এ্যানিমেশন অনলাইন শিক্ষাকে আরও সহজ,আধুনিক, আনন্দদায়ক ও মিথষ্ক্রিয়াশীল করে তোলে। এই সময় আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কোর্স চালু করে, ভৌগলিক দূরত্বের কারনে যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায় না, তাদের মধ্যে এই কোর্সগুলো ব্যপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ডিসনিওয়ার্ল্ডে অনুষ্ঠিত টেকলার্ন কনফারেন্সে এলিয়ট ম্যাসাই ‘ই-লার্নিং’ শব্দের প্রথম ব্যবহার করেন। একুশ শতকের প্রথম দশকে আমরা টেক্সট নির্ভন ওয়েব ১.০ থেকে ওয়েব ২.০ তে শিফট করি। এই পরিবর্তণ ই-লার্নিং এর গুনগত পরিবর্তনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। একুশ শতকের একদম শুরুতে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ইন্ড্রাস্ট্রি নলেজ বাড়ানো ও সুনিদৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক হারে ই-লার্নিং পদ্ধতির দারস্থ হতে শুরু করে।

বর্তমান বাস্তবতা

বাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় ই-লার্নিং স্বকীয় ইন্ড্রাস্টি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ২০১৫ সালে এটি ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের সমান এক বিশাল বাজার ছিলো, ২০২৩ সালে ৫ ভাগ হারে বেড়ে সেটি ২৪০ বিলিয়ন ডলারের বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বলে বিশ্বখ্যাত লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান DOCEBO’র দাবি। এমনকি পাশের দেশ ভারতে ই-লার্নিং প্রায় ১.২৯ বিলিয়ন ডলারের মার্কেট, যা আমেরিকার পর মধ্যে সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার।

এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (LMS) এর বাজারও, যা এখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। মোবাইল প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় ই-লার্নিং বা অনলাইনে শিক্ষার ক্ষেত্রে মুঠোফোনের ব্যবহার দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে, যাকে এম লার্নিং বলে ডাকা হচ্ছে। হ্যা, ওয়েবসাইট থেকে মোবাইল এ্যাপসে যাত্রা শুরু করেছে ই-লার্নিং ইন্ড্রাস্টি। কেবলমাত্র ইল্যাংন্ডে ই-লার্নিং এর ক্ষেত্রে ৭৪ ভাগ মানুষ মোবাইল বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে। সাধারন শিক্ষার্থী থেকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, সবার মধ্যেই বেড়েছে ই-লার্নিং এর প্রতি তুমুল নির্ভরতা। আমরা যদি বিশ্বব্যাপি ই-লার্নিং ইন্ড্রাস্ট্রির ছবি আঁকতে চাই, তাহলে সেটা দেখতে মূলত নিচের ছবির মতো হবে।

লেখাটি শেয়ার করুন:

সাম্প্রতিক লেখা

জনপ্রিয় লেখা

আরও লেখা পড়ুন

আমার
সম্পর্কে

আমি নাসিমূল আহসান। পড়াশুনা করেছি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বর্তমানে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। পাশাপাশি পাটপণ্যের বহুমখিকরণ, বিপনন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইউজুট’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বিশেষায়িত কনটেন্ট মার্কেটিং এজন্সি ‘কনটেন্টো’র প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।