মোবাইল সাংবাদিকতা : কি, কেন?

লেখাটি শেয়ার করুন

লেখাটিতে যা থাকছে

স্মার্টফোনের যুগে

তথ্য প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে সব। খুব সকালে গরম চায়ের কাপের সাথে পত্রিকা পড়ার গল্পটা সেকেলে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নিউমিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাল্টে দিচ্ছে মিডিয়া ইন্ড্রাস্ট্রির প্রচলিত পাঠক-মালিক-সাংবাদিক সম্পর্কের ধারনা। সংবাদ তৈরি আর বিতরণে মিডিয়া কোম্পানিকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কর্পোরেট কনগ্লুমারেট জার্নালিজমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাজারে এসেছে উদ্যোক্তা সাংবাদিকতার ধারনা। সাংবাদিকতা শিল্পে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অল্প পুঁজিতে তৈরি করছে অনলাইন পত্রিকা। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যানে বৈশি^ক তথ্যগ্রামে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন গণমাধ্যম। সাংবাদিকতার প্রচলিত আদল ভেঙে আমরা ঢুকে পড়েছি নাগরিক সাংবাদিকতার যুগে। কোন এক নাগরিক সাংবাদিকের মুঠোফোনে তোলা ভিডিও চিত্র নিয়ে হৈচৈ পড়ে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। ফেসবুকের একটি স্টাটাস হয়ে উঠছে সংবাদপত্রের লিডস্টোরী।

বিখ্যাত পরিসংখানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টাটিসটা জানাচ্ছে পৃথিবীর ৩.৩ বিলিয়ন স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, গোটা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২.৬৩ শতাংশ। হ্যা, আর এই স্মার্টফোন ইউজাররাই হয়ে উঠছেন নতুন যুগের সাংবাদিক। কনটেন্ট নির্মাতা। যাদেরকে ২০১৫ সাল থেকে ‘মোজো’ নামে অভিহিত করে পোর্ট মেয়ারস নিউজ প্রেস নামের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান।

সাধারনত স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির মতো ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা ও প্রচারের কাজ করাকেই আমরা মোবাইল সাংবাদিকতা হিসেবে অভিহিত করছি। নিকোলে মালায়ারভ বিখ্যাত অনলাইন পত্রিকা মিডিয়াম-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জানান ২০২০ সাল নাগাদ বিশ^ব্যাপি মোবাইল ব্যবহারির সংখ্যা গিয়ে ঠেকবে ৫.৫ বিলিয়নে। আর এই জনগোষ্ঠির প্রায় বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকবেন দিনের অনেকটা সময়। মূলত এরাই নির্ধারন করে দিচ্ছেন সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ। কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে যেমন, কনজিউমার হিসেবেও তেমন। আর সে কারনেই মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে সারা পৃথিবীতে নতুন করে ভাবার, কাজ করার পরিসর তৈরি হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মোবাইল সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে আলাপ তুলতে চাই। পাশাপাশি একজন নাগরিক সাংবাদিক কিংবা গণমাধ্যম শিক্ষার্থী বা কর্মী হিসেবে আপনি কিভাবে মোবাইল সাংবাদিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবেন, সে ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনাও এগিয়ে নিতে চাই।

কাকে বলি মোবাইল সাংবাদিকতা ?

মূলত সারা পৃথিবীতেই মোবাইল প্রযুক্তি নির্ভর সাংবাদিকতার চর্চা একইসাথে নাগরিক সাংবাদিকতা ও প্রচলিত গণমাধ্যমের সাংবাদিকতার চর্চার জায়গায় বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সেটা যেমন কনটেন্ট তৈরি ও পরিবেশনে, তেমনি আয়োজনে। মোবাইলের মাধ্যমে একজন সাধারন নাগিরক বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করে এবং ইন্টারনেটের সহায়তায় সংবাদ তৈরি ও সম্পাদনা করে নিজের কমিউনিটিতে যেমন দ্রুত একটি ঘটনা বা সংবাদকে পৌঁছে দিতে পারছেন, তেমনি একজন মূলধারার গণমাধ্যমকর্মী মোবাইল প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে মফ¯^লে বসে সংবাদ ঘটনার সরাসরি স¤প্রচার, জরুরি ছবি ও ফুটেজ পাঠাতে পারছেন কম খরচে। মোবাইল সাংবাদিকররা যে কেবল মোবাইল ব্যবহার করেই সাংবাদিকতা করবেন, এমনটা মোটেই নয়। অনেক সাংবাদিক স্মার্টফোন ব্যবহারের পাশাপাশি ডিএসএলআর ব্যবহার করছেন, তবে স্মার্টফোনকেই সবাই মোবাইল সাংবাদিকতার প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করছেন বোদ্ধারা, যার মাধ্যমে রেডিও, পডকাস্ট থেকে শুরু করে টেলিভিশন, তথ্যচিত্র ও সোশাল মিডিয়ার জন্য ভিডিও তৈরি হয়ে থাকে।

আয়ারল্যান্ডের আরটিই নেটওয়ার্কের ইনোভেশনস প্রধান গ্লেন মালক্যাহি স্মার্টফোন ব্যবহার করে ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা, লেখা এবং প্রকাশ করার প্রক্রিয়াকে মোজোর “শুদ্ধতম ধারণা” হিসেবে অ্যাখ্যা দেন। তার মতে মোবাইল সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হল, মানুষকে এমন ভাবে ¶মতায়িত করা, যাতে সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো ভিডিও স্টোরি তৈরি করতে পারেন। অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত টেলিভিশন প্রোডিউসার ইভো বুরামের মতে, মোজো হচ্ছে দ¶ ডিজিটাল স্টোরিটেলিং এবং টুলসের এমন সমš^য়, যা প্রাথমিক ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট (ইউজিসি) থেকে একটি পরিপূর্ণ ইউজার জেনারেটেড স্টোরির (ইউজিএস) জন্ম দেয়।

কেন মোবাইল সাংবাদিকতা

ভিডিও জার্নালিজম, রেডিও সাংবাদিকতা, ফটোগ্রাফি, তথ্যচিত্র তৈরি, ইনফোগ্রাফিস তৈরি, নিউজ লেখা, ই- মেইল করা, যার যার প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সার্ভারে সম্পাদিত ফুটেজ আপলোড করা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট বা নিউজ শেয়ার করা- যাবতীয় সকল কাজ করা যায় এই স্মার্টফোনে। এসব কারনেই দিনকে দিন মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিতে জনপ্রিয় হচ্ছে স্মার্টফোনের চর্চা।

বাংলাদেশের দিকে তাকান। একজন ব্রডকাস্ট জার্নালিজম যখন একটি সংবাদ কভার করতে বেরোন, সে এক মহা আয়োজন। বিশাল ক্যামেরা, তার সাথে এক বা একাধিক ক্যামোরা জার্নালিস্ট, ভারী ট্রাইপড, এক গাদা তার, সাউন্ড ডিভাইজ, বুম আর সাথে গাড়ি তো আছেই। কিন্তু এই জায়গাটা একটু একটু করে ভেঙে দেবে মোবাইল সাংবাদিকতা। মোবিলিটির প্রশ্ন আছে, আছে এ্যাফোর্ডোবিলিটর প্রশ্ন। দ্রুত, তাৎক্ষনিক, ব্রেকিং নিউজ করার জন্য এখন বিশ^জুড়ে মোবাইলকেই সবচেয়ে ভালো টুলস হিসেবে বিবেচনা করছে নিউজরুম। পাশাপাশি সাংবাদিকতায় মোবাইলসহ অন্যান্য আনুসাঙ্কিক টুলসের সহজ পরিবহনযোগ্যতা মোবাইল সাংবাদিকতাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। এছাড়া খুব ভারি ও বড় রিপোর্টিং টুলসের (ক্যামেরা) তুলনায় মোবাইল ভীড়ের মধ্যে সাংবাদিকের ঝুঁকি যেমন কমায়, তেমনি ভিড়ের মধ্যে খুব কাছ থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার সুযোগ করে দেয়। আমাদের চ্যানেলগুলো এখনও যেখানে ঐউ ফুটেজ ব্যবহার করছে বড় বড় টেলিভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করে, সেখানে ভালো মানের স্মার্টফোন একজন সাংবাদিককে ৪ক মানের ফুটেজ দিচ্ছে খুব সহজে। এছাড়া মোবাইলের মাধ্যমে যখন তখন রিয়েল টাইমে লাইভ স্ট্রিমিং করা এখন যতটা সহজ, তা গত দশ বছর আগেও ছিলো কল্পনাতীত। এছাড়া বিশ^জুড়ে কনভারজেন্স জার্নালিজমের কথা হচ্ছে। সাংবাদিকতার এই নতুন ধারনার হাওয়া এসে লেগেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও। দৈনিক প্রত্রিকা সারাদিনের সেরা সংবাদ নিয়ে পড়েন দিন পাঠকের হাতে পৌছুচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নতুন যুগের সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জের কারণে তাকে একটি অনলাইন করতে হচ্ছে। সেখানে প্রতি মূহুর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাৎক্ষনিকভাবে পাঠকের জন্য প্রকাশ তো হচ্ছেই, তেমনি অনেক সময় ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ঠ ভিডিও শেয়ারের বিষয়টি ঘটছে নিয়মিত। আর এসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই মোবাইল সাংবাদিকতা অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

সাধারণত স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা পছন্দের অ্যাপ দিয়ে ছবি বা ভিডিও তৈরি, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ভিজিট করা অথবা ইন্টারনেটে দ্রুত বার্তা আদান-প্রদান ও কথা বলার কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া স্মার্টফোনের সাহায্যে আজ গণমাধ্যমের সংবাদ জানার কাজ আগের চেয়ে অনেক সহজতর হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের নামীদামি গণমাধ্যমের বার্তাক¶ে সংবাদ পৌঁছে দিতে স্মার্টফোন নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। বিবিসি তাদের প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষ্ঠান ক্লিকসহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পুরোটাই ধারণ ও সম্পাদনার কাজ করেছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে টেলিভিশন মোবাইলের সবটুকু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত অনেক টেলিভিশন সংবাদকর্মী ইদানিং বিভিন্ন ঘটনার ফুটেজ তাদের স্মার্টফোনে ধারন করেন। এমনকি অনেক¶েত্রে সরাসরি স¤প্রচার করার কাজটিও সাংবাদিকরা গ্রাম থেকে স্মার্টফোনের মাধ্যমে করতে শুরু করেছেন। এই চর্চা যেমন গণামাধ্যম প্রতিষ্ঠানের খরচ কমিয়ে দিচ্ছে, তেমনি এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রেরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সাধারন নাগরিকদেরও মোবাইলের মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনার সংবাদ, ছবি ও ভিডিও গ্রহনে আগ্রহী করে তুলতে পারেন। এটা করতে পারলে গণমাধ্যমে রিয়েল টাইমে আরও আরও সংবাদ ফুটেজ আসবে, যা সাংবাদিকতার চর্চাকে বৈচিত্রের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, যেখানে সাধারন জনগন ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করেছেন, আর তার পরপরই সেটি হয়ে উঠেছে টক অব দ্যা টাউন !

মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিকে তার প্রয়োজনেই মোবাইল সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকতে হবে। নিজের কর্মীদের কাছ থেকে এখন আর কেবল সংবাদবিবরনী নয়, সাথে ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আদায়ের কাজটিও করতে হবে। এ অবস্থার বিবেচনায় গণমাধ্যমে টিকে থাকতে হলে সাংবাদিকদেরও মোবাইল ব্যাবহার করে ভিডিও স্ট্রোরী তৈরি করা জানতে হবে। সংবাদের পাশাপাশি ছবি, ভিডিও ফুটেজ পাঠাতে হবে।

লেখাটি শেয়ার করুন:

সাম্প্রতিক লেখা

জনপ্রিয় লেখা

আরও লেখা পড়ুন

আমার
সম্পর্কে

আমি নাসিমূল আহসান। পড়াশুনা করেছি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বর্তমানে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। পাশাপাশি পাটপণ্যের বহুমখিকরণ, বিপনন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইউজুট’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বিশেষায়িত কনটেন্ট মার্কেটিং এজন্সি ‘কনটেন্টো’র প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।